কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দে। বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি এবং সংগীতকার তিনি। তাঁর মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনাহীন। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি কবি এবং গীতিকার। চালিয়েছেন লেটো গানের দলও।
কবিতার ইতিহাসে কাজী নজরুল ইসলামের 'বিদ্রোহী' এক অনন্য সাধারণ সৃষ্টি। ঠিক শতবর্ষ আগে রচিত এই কবিতা এখনো প্রাসঙ্গিক এবং কবিতাটি পেয়েছে অমরত্ব, থাকবে চিরকাল বেঁচে এই কবিতা। মাত্র ২২ বছর বয়সে নজরুল রচনা করেন প্রায় ১৫০ পঙক্তির এই ভুবনবিজয়ী কবিতাটি। নজরুল 'বিদ্রোহী' রচনা করেন ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। জন্মদিনে কবিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখছেন রাধামাধব মণ্ডল।
বাংলার ১১ জৈষ্ঠী বিদ্রোহী কবির ১২৩ তম জন্মদিন, অপরদিকে কবির কালজয়ী বিদ্রোহী কবিতাটির এবার শতবর্ষের জন্মদিন। ভাবা যায়! অখণ্ড বর্ধমানের অখ্যাত কালোমাটির দেশে চুরুলিয়াতে জন্ম ছিলেন। বড় হয়েছিলেন। সেই নজরুলের মাটিতে এখনও বাবলাগাছের জঙ্গল। অজয়ের উত্তপ্ত হাওয়া। আর সেখানেই জন্মে কবি ছুঁয়ে ছিলেন আকাশ। স্থায়ীত্বের আকাশ। কবি রবীন্দ্রনাথ তখন মধ্য গগনে। তাঁকেও স্পর্শ করেছিলেন তিনি। যেন কালবৈশাখী ঝড়।
প্রেমিক এই কবির হৃদয়েও ছিল বিদ্রোহের সুর। তা বোঝা গেল তাঁর গানে ও কবিতায়। কারার ঐ লৌহ কপাট কিংবা বিদ্রোহী, কুলিমজুরেও তার প্রভাব পরেছে।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে কবি নজরুল ইসলাম লিখে ছিলেন বিদ্রোহী কবিতা। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতা আন্দোলনের যে উদ্মাদনা প্লাবন এনেছিল, তাতে শক্তি জোগায় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা বিদ্রোহী। বাংলা শুধু নয়, গোটা ভারতবর্ষ কাঁপানো এই কবিতা রচনার ১০০ বছর পূর্ণ হলো। কবির জন্মদিনে তাঁর অমর সৃষ্টিকে দিয়েই কবিকে স্মরণ করবো এবার।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯১৭ সালের ঠিক শেষ দিকে সেনাবাহিনীতে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক হয়ে কাজে যোগ দেন। প্রথমে তাঁর পোস্টিং হয় করাচি সেনানিবাসে। প্রথাগত বিদ্যাশিক্ষায় কবির তেমন মন ছিল না। তাই এমন বৈরী পরিবেশের মধ্যেও তিনি নিজেকে গড়তে রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি মৌলবির কাছ থেকে ফার্সি ভাষা রপ্ত করেন। জানা যায়, এই সেনানিবাসেই তাঁর জীবনের কাব্যচর্চার সূচনা ঘটে। কবি নজরুল সৈনিক অবস্থায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধক্ষেত্রে অংশ নিয়ে দেখেছেন যুদ্ধের ভয়াবহতা। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন ঔপনিবেশিক শোষণ আর রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র। ১৯২০ সালে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হলে কবি নজরুল মনকষ্টে ফের কলকাতায় ফিরে আসেন। তখন তিনি বাস করতে শুরু করেন ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসের একটি ঘরে। একদম তখন থেকেই কবি বেছে নেন সর্বক্ষণের সাহিত্যচর্চা, সাংবাদিকতা আর নানান রাজনৈতিক আন্দোলনের ত্রিমুখী জীবন।
নজরুল তখন বসবাস করতেন কলকাতার ৩২ কলেজ স্ট্রিটের সাহিত্য সমিতির একটি অফিসে। সে সময় মুজফফর আহমেদ ছিলেন সমিতির সহকারী সম্পাদক। পত্রিকার কাজ পরিচালনার সময়েই চিঠিপত্রের আদানপ্রদানের মাধ্যমে কবি নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পরে গভীর বন্ধুত্বও হয় কবির সঙ্গে। সে সময়েইকবি কাজী নজরুলের সঙ্গে ঠিক করেন তিনি একটি ভিন্নধর্মী বাংলা দৈনিক কাগজ বের করবেন। এ বিষয়ে তাঁরা পরবর্তী কালে কথা বলেন ফজলুল হকের সঙ্গে। এবং হক সাহেব তাঁর নিজের টাকায় পত্রিকা বের করার প্রস্তাব দেন, তাঁদের কাছে। ১৯২০ সালের ১২ জুলাই মুজাফ্ফর আহমদ এবং কাজী নজরুল ইসলামের যুগ্ম সম্পাদনায় 'নবযুগ' নামের সান্ধ্য পত্রিকা টি বের হয়। কাজের সুবিধার্থে তাঁরা তখন একসঙ্গেই বসবাস করতে শুরু করেন।
১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে কবি নজরুলের সঙ্গে পরিচিত হন বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে প্রকাশক আলী আকবর খানের সঙ্গে। শেষপর্যন্ত আলী আকবর খান কবির বিয়ে ঠিক করেন ভগ্নি নার্গিস খানমের সঙ্গে, শোনা যায়। এবং কবির সহমতে বিয়ের সসমস্তটা সম্পন্ন হওয়ার পরেই কবিকে ঘরজামাই থাকার শর্ত নিয়ে তাঁদের বিরোধ বাধে। কবি ঘরজামাই থাকতে অস্বীকার করেন। এবং শেষমেশ কবি বাসর সম্পন্ন হওয়ার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান, কাউকে কোনোকিছু না বলেই। এই সময় কবি নজরুল অসুস্থও হয়ে পড়েন শোনা যায়। বিরজা দেবী যথাসাধ্য তাঁর সেবা করেন। কবিকে সুস্থ করতে। আবার সুস্থ হয়ে নজরুল ফিরে আসেন কলকাতায়। কলকাতায় তখন কবি নজরুলের ঠিকানা ৩ /৪-সি তালতলা লেন। দোতলা বাড়ির নিচের তলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটিতে থাকেন মুজফ্ফর আহমেদ আর তাঁর সঙ্গী কবি নজরুল।
তিলোত্তমা কলকাতার তালতলার বাড়িটি ছিল ভাড়ার বাড়ি। এই বাড়িটি প্রথমে ভাড়া নিয়েছিলেন ত্রিপুরা জেলার নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর দৌহিত্ররা। ওপরে-নিচে মোট চারটি ঘরের দুটি ঘরের একটি ঘরে থাকতে হয়েছিল তাদের। ১৯২১ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বের সময়ের প্রভাব বিশ্বব্যাপী অবক্ষয়, নৈরাজ্য এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা নামিয়ে এনেছিল। যা তাঁকে তীব্রভাবে আলোড়িত করে। আধুনিকতাবাদীদের মনের মধ্যে তখন সবে পরিবর্তন শুরু হয়েছে।
পরিবর্তে ব্যক্তি পর্যায়ে আত্মউন্মোচনের প্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠে। ঠিক ওই সময়েই ধূমকেতুর মতো কবি কাজী নজরুল ইসলামের অতুলনীয় প্রতিভার প্রকাশ ঘটতে শুরু হয়। তিনি মিটিয়েছেন সে সময়ের সবচেয়ে কঠিন দাবি। উত্তাল সেই সময়ে, ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে নজরুল রচনা করেন তাঁর কালজয়ী কবিতা এই 'বিদ্রোহী'টি।
ব্যক্তিগত জীবনের প্রণয় বিয়োগ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর অভিজ্ঞতা, জাতীয়তাবাদী ভাবের আশ্রয়ের মিশ্রণে অনুভূতির উর্বরক্ষেত্রে জন্ম হয় নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা।
বিদ্রোহী কবিতা কত তারিখে রচিত হয় তার সঠিক দিন জানা যায় না। কবি নজরুল তাঁর অধিকাংশ রচনার সঙ্গে সময়কাল লেখেননি। তবে তাঁর তৎকালীন সঙ্গী মুজফ্ফর আহমেদের স্মৃতিকথা থেকে জানা গেছে, নজরুলের এই কবিতাটি ১৯২১ সালের বড়দিনের অবকাশকালীন সময়ে অর্থাৎ ২৫ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বরের কোনো এক রাতে কবি আত্মবিহ্বল নজরুল লিখেছিলেন।
'বিদ্রোহী' কবিতাটি লেখা হয়েছিল গভীর রাতে, অন্ধকারে মাখা নির্জন সময়ে। শ্রমক্লান্ত মুজফ্ফর আহমেদ রাত ১০টার পর ঘুমিয়ে পরতেন। সকালে ঘুম থেকে উঠলে কবি তাঁকে শোনান কবিতাটি। এটাই প্রমাণ করে কবিতাটির জন্ম রাতের গভীরে। মুজফ্ফর আহমেদ এবং কবি নজরুল দু'জনের কারও ফাউন্টেন পেন ছিল না। দোয়াত কলমে লেখা নকল করা হতো বটে, তবে তারা লিখতে চাইতেন না সে কলমে। কবি বলতেন লেখার স্বতঃস্ফূর্ততা নষ্ট হয় বারবার কলম ডুবিয়ে কালি নিতে গিয়ে। কবি নজরুল প্রাণের আবেগে কবিতাটি একটানে লেখেন পেন্সিল ব্যবহার করে।
'কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা' বইয়ে মুজফ্ফর আহমেদ এক জায়গায় লিখেছেন, 'আসলে বিদ্রোহী কবিতা রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে বড়দিনের ছুটিতে।' এক স্থানে তিনি লিখেছেন, 'তখন নজরুল ও আমি নিচের তলার পূর্ব দিকের অর্থাৎ বাড়ির নিচেকার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটি নিয়ে থাকি। কবিতাটি নজরুল লিখেছিলেন রাতে। রাতের কোন সময় তা জানি না। রাত ১০টার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি এমন সময় নজরুল বলল, সে একটা কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটিই সে আমাকে পড়ে শোনাল। 'বিদ্রোহী' কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা ছিলাম। আমার মনে হয়, নজরুল শেষ রাতে কবিতাটি লিখেছিল। তা না হলে এত সকালে সে আমাকে কবিতা পড়ে শোনাতে পারত না।'
মুজফ্ফর আহমেদ কাউকে তার সম্মুখে প্রশংসা করতেন না, এটা তাঁর রীতি। অসাধারণ কবিতাটি শোনার পরেও তিনি নজরুলের কাছে কোনো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেননি, জানা যায়। তবে অন্যদের কাছে পরবর্তী সময়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন, কবিতাটি নিয়ে। তাঁর মনে হয়েছে কবি নজরুল হয়তো এই কারণে মনঃক্ষুন্ন হয়েছেন হয়তোবা। স্মৃতিকথায় মুজফ্ফর আহমেদ এর থেকে এইসব তথ্য গুলো পাওয়া যায়। তিনি কবিজীবন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
নজরুলের কাছে সেই বাড়িতে সময়ে সময়ে আড্ডা দিতে আসতেন বিভিন্ন শিল্পী- সাহিত্যিক- সম্পাদকসহ সমাজের বিশিষ্ট জনরা। সেই বাড়িতে এসেছিলেন 'মোসলেম ভারত' পত্রিকার সম্পাদক আফজালুল হক। তাঁকে কবিতাটি পড়ে শোনান কবি নজরুল। শোনার পরই উচ্ছ্বসিত আনন্দে ফেঁটে পরেন আফজালুল হক। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই কবিতাটি "মোসলেম ভারতে " প্রকাশের জন্য কপি নিয়ে যান। তার ঠিক পরই বাড়িতে আসেন "বিজলী" পত্রিকার সম্পাদক অবিনাশচন্দ্র। এই কবিতাটি লেখার পরে পরেই কবি নজরুল ছিলেন দারুণ উজ্জীবিত। তাঁকেও কবিতাটি শোনান কবি। তিনিও কবিতাটি বিজলী-তে প্রকাশের জন্য কবি নজরুলকে বলেন। মোসলেম ভারতের জন্য কবিতাটি দিয়েছেন জানালেন কবি। তবে অবিনাশচন্দ্র সেক্ষেত্রে বলেন, মোসলেম ভারত মাসিক পত্রিকা, উপরন্তু পত্রিকাটি অনিয়মিত। আর বিজলী একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। প্রতি সপ্তাহে পত্রিকাটি প্রকাশ পাচ্ছে। এমন অগ্নিঝরা কবিতা প্রকাশে বিলম্ব হলে সমাজের ক্ষতি, এক্ষেত্রে তিনি যুক্তি দেন। কবি নজরুলও তাঁর যুক্তি তাৎক্ষণিক ভাবে মেনে নিয়েছিলেন। অবিনাশচন্দ্রও শেষ পর্যন্ত কবিতাটির একটি কপি করেন। অবিনাশ চন্দ্রের এই প্রবল আগ্রহের কারণেই, সপ্তাহখানেক পরে ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি সাপ্তাহিক বিজলী'তে বিদ্রোহী কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। সে সময় কবিতাটি ছিল ১৩৯ পঙ্ক্তির।
প্রকাশের দিন ছিল বৃষ্টিমুখর। এই কবিতাটি প্রকাশের কারণে পত্রিকার চাহিদা এতো বেশি হয়েছিল যে জানা যায়, বিজলী'র দুটি মুদ্রণ বের করতে হয়েছিল। মোসলেম ভারত পত্রিকার ফাল্গুন মাসে আবার ছাপা হয় কবিতাটি। আর প্রকাশের পর থেকেই সাহিত্যের পাঠক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, আবৃত্তিশিল্পী, রাজনৈতিক কর্মী, সচেতন মানুষের কাছে প্রবলভাবে জনপ্রিয় হয় বিদ্রোহী। মাসিক প্রবাসী, মাসিক সাধনা, সান্ধ্য পত্রিকা নবযুগ, নজরুল সম্পাদিত ধূমকেতু ইত্যাদি পত্রিকাতেও 'বিদ্রোহী' প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাটির প্রবল চাহিদা লক্ষ করে চলমান বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক পত্রিকা তখন কবিতাটি কে বার বার ছাপতে থাকে। কবিতাটির প্রতি সবার এমন আগ্রহ দেখে কবি নজরুলও এই বিষয়ে তেমন আপত্তি করেননি।
কবিতাটি প্রকাশের দশ দিন পর ১৭ জানুয়ারি ১৯২২ সালে নজরুল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে যান। তাঁকে কবিতাটি পড়ে শোনান নজরুল। বিজলী সম্পাদক অবিনাশচন্দ্র নজরুলের মুখে শুনে লিখেছেন, বিদ্রোহী ছাপা হওয়ার পরে নজরুল এটি রবীন্দ্রনাথকে পড়ে শোনানোর পর তিনি সানন্দে নজরুলকে বুকে চেপে ধরে আশীর্বাদ করেছিলেন।
বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, 'বিদ্রোহী' পড়লুম ছাপার অক্ষরে মাসিক পত্রে- মনে হলো, এমন কখনো পড়িনি। অসহযোগের অগ্নিপরীক্ষার পরে সমস্ত মনপ্রাণ যা কামনা করেছিল, এ যেন তা-ই, দেশব্যাপী উদ্দীপনার এ-ই যেন বাণী।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বলেছিলেন, এ কে নতুন কবি? নির্জীব দেশে এ কার বীর্যবাণী? শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, সমগ্র দেশ নাড়া দিয়ে জেগে উঠল। এমনটি কোনোদিন শুনিনি, ভাবতেও পারিনি। যেন সমস্ত অনুপাতের বাইরে, যেন সমস্ত অঙ্ক পাতেরও অতিরিক্ত।...গদগদ বিহ্বলের দেশে এ কে এলো প্রচণ্ড বজ্রনাদ হয়ে? আলস্যে আচ্ছন্ন দেশ আরামের বিছানা ছেড়ে হঠাৎ উদ্দ- মেরুদণ্ডে উঠে দাঁড়াল।
নজরুল গবেষক জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম 'বিদ্রোহী' কবিতা সম্পর্কে বলেন, 'প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব, ভারতের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, তুরস্কের কামাল পাশার আবির্ভাব, বাংলা সাহিত্যের এসব পটভূমি নজরুলকে বিদ্রোহীর মতো কবিতা লেখার জন্য প্রভাবিত করেছে।...নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা বদলে দেয় বাংলা সাহিত্যের ধারা। বাংলা সাহিত্যে 'আধুনিক কবিতা' বলতে আমরা যা বুঝি, তার পেছনে রয়েছে 'বিদ্রোহী' কবিতা।...গত একশো বছরে বহু আন্দোলন-সংগ্রামে কবিতাটি বাঙালিকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। কেবল 'বিদ্রোহী'র জন্য হলেও নজরুল যুগ যুগ স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।'
তবে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও কম হয়নি। সে সময়ে 'শনিবারের চিঠি' সাপ্তাহিক পত্রিকায় নজরুলকে ব্যঙ্গ করে বেশ কয়েকজনের বিদ্রোহী কবিতার প্যারোডি লেখা ছাপা হয়েছিল। সজনীকান্ত দাস বিদ্রোহী কবিতাকে প্যারোডি করে লিখেছিলেন, 'আমি ব্যাঙ/লম্বা আমার ঠ্যাং/আমি ব্যাঙ/আমি সাপ, আমি ব্যাঙেরে গিলিয়া খাই/আমি বুক দিয়ে হাঁটি ইঁদুর ছুঁচোর গর্তে ঢুকিয়া যাই।'
কবি গোলাম মোস্তফাও কাব্যে সমালোচনা করতে ছাড়েননি। তাঁর 'নিয়ন্ত্রিত' শিরোনামের কবিতায় কালজয়ী বিদ্রোহী কবিতাকে আঘাত করার চেষ্টা করেছেন তিনিও। তিনি লেখেন, "ওগো 'বিদ্রোহী' বীর!/সংযত কর, সংহত কর উন্নত তব শির/তুই যদি ভাই বলিস চেঁচিয়ে-উন্নত মম শির,/আমি বিদ্রোহী বীর,/সে যে শুধুই প্রলাপ, শুধুই খেয়াল, নাই নাই/তার কোন গুণ,/শুনি স্তম্ভিত হবে 'নমরুদ' আর 'ফেরাউন'!"
কবিতাটি বাংলায় নবজাগরণের সূচনা করেছিল, সত্যি সত্যিই। সুস্পষ্ট রাজদ্রোহের ঘোষণা থাকলে সে সময়ের ইংরেজ সরকার কবিতাটি নিষিদ্ধ করতে পারেনি। এ সম্পর্কে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বলছেন, এ কবিতায় হিন্দু-মুসলমান দু'ধর্মের এত পুরাণ প্রসঙ্গ ঢুকেছে যে ব্রিটিশ সরকার সরাসরি একে রাজদ্রোহ বলে চিহ্নিত করতে পারে নাই। কখনো ঈশান-বিষানের ওঙ্কার বাজছে, কখনো বা ইস্রাফিলের শিঙ্গা থেকে উঠছে ঝঙ্কার। কখনো বা হাতে নিয়েছে মহাদেবের ডমরু-ত্রিশূল, কখনো বা অর্ফিয়াসের বাঁশি। কখনো বাসুকীর ফণা জাপটে ধরেছে। কখনো বা জিব্রাইলের আগুনের পাখা, কখনো চড়েছে তাজি বোরাক। রাজদ্রোহ বলতে গেলে ধর্মের উপরে হাত দেওয়া হবে।
সরাসরি নিষিদ্ধ করতে না পারলেও প্রকাশিত কপি বাজেয়াপ্ত করা এবং পুড়িয়ে ফেলতে কসুর করত না ইংরেজ সরকার। ফলে যেন সম্পাদক-প্রকাশক-পাঠকের জেদ বেড়ে গেল আরও। তারা আরও বেশি বেশি করে বিভিন্ন পত্রিকায় 'বিদ্রোহী' ছাপাতে লাগলেন।
বিদ্রোহী কবিতার শতবর্ষ উদযাপনে দেশে-বিদেশে গৃহীত হয়েছে নানা কর্মসূচি।
'বিদ্রোহী' কবিতার শতবর্ষ পূর্তিতে বাংলা একাডেমিতে স্মারক ভাস্কর্যের উদ্বোধন করা হয়েছে। বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে এই স্মারক ভাস্কর্যের শুভ উদ্বোধন করা হয়। এ উপলক্ষে ভারতে এই কবিতা টি ১০০ ভাষায় অনুবাদের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভারতের নজরুল সেন্টার অব সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজের পরিচালক এবং ভারতের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক স্বাতী গুহ জানান, এ বছর কবির লেখা বিদ্রোহী কবিতার ১০০ বছর উদ্যাপিত হচ্ছে। এ উপলক্ষে কবির 'বিদ্রোহী' কবিতাটি ভারতীয় উপমহাদেশের ১০০টি ভাষায় অনুবাদের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের সংস্কৃতির মধ্যে আরও বেশি ছড়িয়ে যাবে।
বিদ্রোহী কবিতার শতবর্ষ উদযাপন করতে নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে এ কবিতার ওপর লেখা ১০০ বছরে প্রকাশিত প্রবন্ধ গুলি নিয়ে 'বিদ্রোহী' নামে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকেও একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, বিদ্রোহীকে ঘিরে।