বাংলার ঐতিহ্যের শিল্পতালুকের উন্নয়ণের কাণ্ডারি মহিলারই।

রাধামাধব মণ্ডল 


বাংলার মহিলাদের হাত ধরেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিল গ্রামীণ কুটির শিল্পের আকাশ। সামাজিক কাজে এ-বাংলায় মহিলাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে দ্বিগুণ। বহুক্ষেত্রে মহিলারা এগিয়ে আসছেন নানান অভিজ্ঞতা নিয়ে। সামাজিক সহায়তার নানান প্রকল্পে উপকৃত মহিলারা জীবন ও জীবিকার দৌড়ে এগিয়ে চলেছেন বাংলার নিজস্ব ছন্দে। গ্রামীণ কুঠির শিল্পের নিজস্ব উঠানে শিল্পী মহিলাদের স্বাবলম্বী হওয়ার প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে বাংলার সরকার। উৎসাহ আর সরকারি উদ্যোগে মহিলা শিল্পীদের নিয়ে নানান কর্মসূচি নিচ্ছে প্রশাসন। স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে মহিলা লোক শিল্পীদের লোন দানের মাধ্যমে সামাজিক ভাবে সহায়তা দানের যে কর্মসূচি নিয়েছে সরকার, তাতে বাংলার হারাতে বসা লোকশিল্পের পল্লি গুলোতেও নবজাগরণ এসেছে। 
বাংলার ডোকরা শিল্পীদের ডোকরা শিল্পে, সূচিকর্ম শিল্পে, শঙ্খ শিল্পে, বাঁশ বেত শিল্পে, পুতুল শিল্পে এবং পট ও পটুয়া শিল্পে, মৃৎশিল্পে, শোলা শিল্পের বাজার তৈরিতে মহিলা শিল্পীদের ভূমিকা লক্ষণীয়।  জেলা পুলিশের তরফ থেকে হারানো শিল্পকর্ম বিক্রি করে শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করেছে পূর্ব বর্ধমান জেলা পুলিশ। জেলার আউশগ্রামের দেরিয়াপুরে রয়েছে ডোকরা শিল্পীদের বিরাট পটি। দেশ বিদেশের বাজারে তাদের শিল্পকর্ম নিয়মিত পৌঁছায়। একদা গঙ্গা পাড়ের বাংলায় বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির নানা জাতির বসবাসক্ষেত্রে, নানান লৌকিক শিল্পের চর্চাক্ষেত্র গড়ে উঠেছিল। জীবিকার তাড়নায় গড়ে ওঠা সেইসব শিল্পের একটি সুদীর্ঘ প্রাচীনত্বের ইতিহাস রয়েছে। বাড়িতে বসে বাড়ির মহিলারা সেইসব টিকিয়ে রাখা প্রাচীন লৌকিক শিল্পধারাকে নিয়ে নিজেদের জীবনের রুটিরুজি জোগাড় করেছে। গ্রামীণ কুটির শিল্পীদের নতুন করে বাঁচাতে নানান স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও এগিয়ে আসছে। এই শিল্প গুলোর একটি প্রাচীন উৎপত্তির কারণ এবং তার টিকে থাকার ধারাবাহিক প্রাচীনত্বের ইতিহাস রয়েছে। লৌকিক শিল্প ইতিহাসের এই পথটির প্রাচীনত্ব সুদীর্ঘ সাড়ে সাত হাজার বছরেরও প্রাচীন। পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের পাণ্ডুকের পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে সেই ইতিহাসের আখড় প্রমাণ রয়েছে টিকে।

বুনন শিল্পঃ

বাংলার বুননশিল্প এ শিল্পের মধ্যে টুকরি, ঝুড়ি, ধামা, মাদুর, হোগলা, পাটি ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয় এবং উল্লেখযোগ্য। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় ঝুড়ি একটি নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী উত্তোলন থেকে মজুত করার জন্য এই ঝুড়ি ব্যবহার করা হয়। বাংলায় প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত বাঁশ, বেত, দুর্বা, নল খাগড়া, পাতা, তন্তু প্রভৃতি দিয়ে শিল্পীদের নিজস্ব  সৃজনশীলতা আর দক্ষতার সুযোগ করে দিয়েছে একটি বড় শিল্পক্ষেত্রের। কারুশিল্প হিসেবে ঝুড়ি তৈরিতে বুনন, কুন্ডলীকরণ, পাকানো, বিভিন্ন বর্ণের চৌখুপিদ্বারা শোভিতকরণ বা শিরাতোলন পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। এতে চটা বা বেত দিয়ে ঝুড়ি, টকুই, পেঁচে এবং ধামা তৈরি করা হয়। এগুলো মাটি তোলার কাজে ব্যবহার করা হয় মূলত।
এগুলোকে মজবুত করার জন্য কচুরিপানার পুকুরে বা কর্দমাক্ত ডোবাতে ভিজিয়ে রাখা হয়, জীবাণুনাশক রঞ্জন এবং গাব ফলের রস দিয়ে মোছা হয় শক্ত ও মজবুত করতে। ফলে এগুলো ব্রোঞ্জের মতো উজ্জ্বল রং ধারণ করে এবং নির্ভরযোগ্য হয় অনেক বেশি। এ বাংলার সকল জেলা ও গ্রামে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন ধরণের মাদুর-নিদ্রার জন্য, বসার জন্য, খাদ্য শুকানোর জন্য, ছায়া দেয়ার জন্য ছাদ/চালা মাদুর, দেয়াল-মাদুর বা দরমা, ফলস সিলিং মাদুর ও প্রার্থনার জন্য মাদুর ইত্যাদি তৈরি করা হয়। আর বাংলার মহিলা শিল্পীরাই এই শিল্পকর্ম গুলো নির্মাণ করে। বাড়ি বাড়ি মহিলা মহলে তৈরি হয় এই শিল্পকর্ম। এবং গ্রামে গ্রামে বিক্রির জন্যও মহিলারা নিজেরা মাথায় করে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে আসে। 

চারু এবং কারুশিল্পঃ


চারু ও কারুশিল্প বাংলার ইতিহাসে নন্দনতাত্ত্বিক বিষয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাচীন।  চারু আর কারুশিল্পের গুরুত্বও অনেক বেশি। বাংলাদেশের বগুড়ার মহাস্থান গড়, কুমিল্লার ময়নামতি এবং অতি সম্প্রতি ২০০১ সাল থেকে নরসিংদি জেলার ওয়ারি বটেশ্বরীর খনন কার্য এই প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের নিশ্চয়তা পাওয়া গেছে। খ্রিস্টপূর্ব আনু. ৫০০ অব্দ থেকে জনপদের প্রাচীন বঙ্গের অধিবাসীগণ মৃৎশিল্প, লৌহনির্মিত হাতিয়ার, কাঠের তৈরি বস্ত্তসামগ্রী, নানা প্রকার কৃষিসামগ্রী, ধর্মীয় এবং গৃহকার্যের সামগ্রী প্রস্তুত করত। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেকোনো ধরণের সংস্কৃতির পরীক্ষা নিরীক্ষায় জনসাধারণের তৈরি করা চারু আর কারুশিল্পের মূল বিষয়। জনগণের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অবস্থান, তাদের আধ্যাত্মিক এবং বৌদ্ধিক বিকাশ আর সামাজিক মূল্যবোধের মূল মানদন্ড হচ্ছে হস্তশিল্প সামগ্রী। আমাদের বাংলার বীরভূমের মহিষাদল খননে, এই শিল্পের নিদর্শন মেলে। বীরভূম জেলার ইলামবাজারের লাক্ষা ও গালা শিল্পের নিদর্শনও রয়েছে সুপ্রাচীন কাল থেকে। পূর্ব বর্ধমানের কাঁকসার গড় জঙ্গলের ঢেকারো কামারদের অস্ত্র শিল্পের চাহিদার গুরুত্বও সুপ্রাচীন ইতিহাস বর্ণিত। 
চিরায়ত উচ্চমাত্রার শিল্পকলা বাংলার ভাস্কর্য প্রায় হাজার বছর ধরে বাংলার হিন্দু-ভাস্কর্য সৃষ্টি হয় এবং তাঁরই ধারাবাহিকতায় এই সময়ে ধর্মীয় এবং পটশিল্পের কিংবা মূর্তিতত্ত্বের ধারণা উচ্চমাত্রায় পৌঁছে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন প্রকার ভাস্কর্য শিল্পকর্ম আবিষ্কারের ফলে নানা ধরণের জটিলতার অবসান হয়েছে। পাল ও সেন সাম্রাজ্যের ভাস্কর্য সম্পর্কিত গবেষণায় যে সীমাবদ্ধতা ছিল তা দূরীভূত হয়ে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়েছে আমাদের বাংলায়।
তামা, ব্রোঞ্জ আর পিতলের দেবদেবীর মূর্তি এবং হাতে তৈরি শিল্পকর্ম ধাতুবিদ্যায় বৈদিকজ্ঞানের উত্তরাধিকার আজও বাংলার সুন্দর তাম্রনির্মিত চারু আর কারুকলায় বিদ্যমান। ধাতব শিল্পের জন্য বিখ্যাত স্থানসমূহ আমাদের বাংলায় পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের দীননাথপুর, বক্সীবাঁধ, নৃসিংহপুর, পুরোনো হাট, কাটোয়া। পশ্চিম বর্ধমানের কাঁকসার গৌরবাজার, ভিমগড়, লোহাগড়া, গড়কেল্লা এবং বীরভূমের লোহাগড়া, কাষ্ঠগড়িয়া, সুপুর, নূরপুর, ঘুরিষা আর পদ্মাপারের বাংলাদেশের- রাজশাহীর চাপাই নবাবগঞ্জ, ঢাকার সন্নিকটে ধামরাই, শিমূলিয়া, সাভার, ময়মনসিংহের ইসলামপুর, দরিয়াবাদ, টাঙ্গাইল। এছাড়া অন্যান্য স্থানের মধ্যে রয়েছে কাগমারি এবং বাঘাইল। মন্দির আর ধর্মীয় উৎসবের জন্য নির্মিত উচ্চ নন্দনতাত্ত্বিক অলঙ্কারের মধ্যে রয়েছে পুষ্পপত্র বা ফুল, অর্চনার জন্য তাম্রনির্মিত থালা, রেকাব, বোল, ঘণ্টা, মন্দির-প্রদীপ, পঞ্চপ্রদীপ, নারী আকৃতির প্রদীপ, দেবতাকে জাগ্রত করার জন্য ঘন্টা, গরুড়, হনুমান, গণেশ বা পাখির আকৃতি দিয়ে তৈরি হাতঘন্টাও নির্মিত।
প্রাচীন ষাড় বা ময়ূর আকৃতির উপর স্থাপিত বারকোষ, মানত করার নিবেদিত অর্চনাও তৈরি হয়। পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে বিশাল আকৃতির রথকে তামা এবং পিতলের বস্তু সামগ্রী দিয়ে সম্পূর্ণরূপে সজ্জিত করা হয়। বাংলার একটি বিখ্যাত চারু আর কারুশিল্পের নিদর্শন দেখা যায় মাদুর বোনা পদ্ধতিতে তৈরি বিভিন্ন শিল্পকর্মের মধ্যেও। এই পদ্ধতিতে তামা, পিতলের তার দিয়ে ভাতের বোল, ধূপতি এবং গ্রাম্য দেবতা তৈরি করা হয় যা পূজা-অর্চনার সময় পাশে রাখা হয়।

কর্মরত শাঁখারিঃ

শঙ্খ শিল্পের জনপ্রিয় কারখানা ছিল পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়া, কালনা, এবং আউশগ্রামের দীননাথপুরে। বাংলার বাঁকুড়ার হাটগ্রামেও রয়েছে শঙ্খ শিল্পীদের বিরাট গ্রাম। বহু মহিলা শিল্পী এই গ্রাম গুলোতে কাজ করে চলেছে। পূজা অর্চনার জন্য ঝুড়ি-সাজি-ডালা  বিগ্রহ বা মূর্তির উদ্দেশ্যে ফুল, পাতা ছিটিয়ে দেওয়ার জন্য এক ধরণের ছোট পাত্র যা ফুলের সাঝি যেমন ব্যবহার করে, তেমনই লাগে শাঁখা। মাটির তৈরি পলাও, প্লাস্টিকের শাঁখাও এখন চলে এসেছে বাজারে। মূলত মহিলা শিল্পীরাই এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। 
 বিবাহ উৎসবে ব্যবহূত সামগ্রী হিসেবে শাঁখা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
শঙ্খ-শাখা  হিন্দু বিবাহ অনুষ্ঠানে শঙ্খের তৈরি শাখা একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ আজও। প্রতিটি কনে বিবাহের সময় দাম্পত্যজীবনের শপথ রক্ষার জন্য একজোড়া শঙ্খ-শাখা দুই হাতে পরে।
সিন্দুর এক ধরণের লাল পদার্থ যা বিবাহিত মহিলারা বিবাহের প্রতীক হিসেবে সিঁথিতে ব্যবহার করে আর তার সঙ্গেই পরে শাঁখা। শাঁখ কাটার করাত শিল্পের এশিয়া মহাদেশের বিখ্যাত কারখানা ছিল পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের দীননাথপুরে। সেখানকার হলধর কর্মকার, জলধর  কর্মকার, বেচারাম কর্মকাররা ছিলেন জগৎ জোড়া শিল্পী। করাত তৈরির বরাত পেতেন নানান দেশ থেকে তারা।

কর্মরত কাঁসারুঃ

মুকুট বা টোপড় শোলার কাঠি দিয়ে তৈরি বহুস্তর বিশিষ্ট মস্তকা বরণী। কাঁসার টোপর, মুকুটও বিখ্যাত ছিল। বিবাহের অন্যান্য পোষাক-পরিচ্ছদের সঙ্গে হিন্দু বরেরা এটি মাথায় ব্যবহার করে, অতীতে ছিল কাঁসার তৈরি টোপর।
কনের টায়রা  বিবাহের সময় অবগুণ্ঠন হিসেবে কনে তার কপালে পরতো, তাও কাঁসার তৈরি। শোলার কাঠি দিয়ে তৈরি কপালির দুই পাশ দিয়ে ঝলমলে ঝুলন্ত ঝালর থাকে, তা কাঁসার তৈরি।
মালা শোলা গাছের পাতলা কাঠি সূক্ষ্মভাবে টুকরো, বাঁকা করে এবং তার মধ্যে ফুলের পাপড়ি আঠা দিয়ে লাগিয়ে মালাকার নামে পেশাজীবী শিল্পীরা মালা তৈরি করে, যা বিবাহ উৎসবের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ আজও। বিবাহের বর এবং কনে উভয়ে মালা বদল করে বিবাহ কাজ সম্পন্ন করে সেখানেও কাঁসার পাত্র ব্যবহার করা হয়।
কব্জী রাখি-বন্ধন  বিশ্বস্ততার শপথ হিসেবে হাতের কব্জিতে ব্যবহূত পাকানো সুতার বন্ধন। এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানটি সাধারণত বিবাহের পূর্বে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে করা হয়।
শঙ্খ  হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠান-বিবাহ, জন্ম, মৃত্যু, বিজয়, পূজা ইত্যাদিতে শঙ্খধ্বনি করা হয়, সেইসঙ্গে কাঁসার পাত্র ব্যবহার খুব জরুরি। বিবাহে দানপত্র সহ বহু কাঁসার তৈরি জিনিষ লাগে।
রথ ও মন্দির আচ্ছাদন রথকে সজ্জিতকরণের জন্য কাপড় কেটে সেলাই করে নকশি করা হয় এবং কাপড় দিয়ে দেবতার বেদীর চারপাশ ঢেকে দেওয়া হয়, তবে কাঁসার তৈরি চারটি রথ রয়েছে আমাদের বাংলায়। তার মধ্যে জনপ্রিয় কাঁসার রথ দুটি হল পশ্চিম বর্ধমানের বনকাটির রথ, বীরভূমের জয়দেব কেন্দুলীতে মহান্তদের পিতলের রথ এবং উখড়ার হাণ্টার পরিবারের পিতলের রথ। বনকাটির পিতলের রথের এসব রেখাচিত্রের মূল শিল্পকর্ম যে দেবতাকে পূজা করা হয় তার মূল গুণাগুণের ওপর ভিত্তি করেই অঙ্কন করা হয়েছিল। যা দেখতে একসময় বিশ্বভারতী থেকে নন্দলাল বসু এসেছিলেন, কাঁকসার বনকাটিতে।
দেবতা জগন্নাথের সম্মানে ধামরাইয়ে বাৎসরিক রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানের পূর্বে রথকে সম্পূর্ণরূপে সজ্জিত করা হয় পিতলের মোড়ক দিয়ে।
পিতল, কাসা এবং মিশ্রধাতু  ইন্দো-গঙ্গা উপত্যকার সভ্যতায় প্রথম সুসংগঠিত সমাজব্যবস্থার পত্তনের শুরু থেকে এই এলাকার শিল্পীদের একটি প্রাচীন পেশা ছিল মন্দিরের পূজার জন্য হাতে নির্মিত কারুশিল্প তৈরি করা। ধর্মীয় উৎসবের দ্রব্য সামগ্রীর মধ্যে ছিল ঘন্টা, কাঁসি, সংগীতের বাদ্যাদি, জল-কলস, বোল, থালা, তৈল প্রদীপ, দন্ডায়মান প্রদীপ আর অগণিত ব্রোঞ্জের প্রদীপ, রূপা এবং সোনার মালা।
অনেকেই গ্রামে গ্রামে ঘরি বাজিয়ে ফেরিওয়ালারা ঘুরতেন কাঁসার জিনিষ বিক্রির জন্য।


আদিবাসী রমনীর বস্ত্র বুননঃ

উপজাতি কারুশিল্প উপজাতি সমাজের জনগণ পুজো, উৎসবে ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন প্রকার চারু, কারুশিল্প তৈরি করে। প্রতিটি উপজাতি সম্প্রদায়ের জনগণ ভিন্ন ভিন্ন চারু আর কারুশিল্প তৈরি করে আজও বাংলার বহু গ্রামে গ্রামে। বস্ত্রসামগ্রীর বুনন কৌশলের কারণেই হাতে তৈরি করা ধর্মীয় দ্রব্যসামগ্রী হিসেবে এগুলোর মূল্য প্রদান করা হয়। হাতে তৈরি কাপড়, প্রাকৃতিক রং, প্রাচীন তাঁত আর গুপ্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠান বাংলাদেশের উপজাতি সম্প্রদায়ের বস্ত্রশিল্পের অন্যন্যতা প্রদান করে আসছে। প্রতিটি উপজাতি তাদের নিজস্ব চারু আর কারুশিল্প তৈরি করে; যা তাদের পুজো অর্চনায় ব্যবহার করা হয়।
আদিবাসী সমাজের জনগণ প্রকৃতি থেকে বিশেষ ধারনা নিয়ে অলঙ্কার এবং অন্যান্য শিল্প সামগ্রীর আকার, নকশা তৈরি করে। মাকড়সার জালের মতো কানের দুলকে 'মাকড়' এবং বৃশ্চিকের পায়ের মতো শত জোড়া বিশিষ্ট রূপার তারের কোমর বন্ধকে 'বিচ্ছু' বলে এখনও। হাজার বছর পূর্বে আসাম, তিব্বত, বর্মা আর মঙ্গোলিয়ার বংশোদ্ভূত উপজাতি সম্প্রদায়ের আগমনের ফলে এখানকার নকশায় বৈচিত্র্য লাভ করেছে। এসব কাজে পূর্বাঞ্চলীয় শিল্পের বিশিষ্টতা থাকলেও কোনোটিতেই প্রতীক বা ধর্মীয় গুরুত্বের অভাব নেই এখনও। আমাদের বাংলার কয়েক হাজার আদিবাসী গ্রামে আজও এই শিল্পের জনপ্রিয়তা অখুন্ন রয়েছে।


বালিঃ

নাগফুল (নাক ফুল)  মেয়েদের নাক সাজাবার জন্য বা পাশের নাকের ছিদ্রে ব্যবহূত এক প্রকার অলঙ্কার বিশেষের নাম। এর আকৃতি ক্ষুদ্র তারকার মতো, তাই কী বালি; বলছেন গবেষকরা।
সোনার নাকফুল কিংবা সোনা নথ  বাম দিকের নাকের ছিদ্রতে ব্যবহার্য বোতাম সদৃশ গুলিকা বা ঘন্টির মতো এক প্রকার অলঙ্কার বিশেষ। এর আকৃতি বিভিন্ন প্রকার ফুল বা জ্যামিতিক আকৃতির হয়ে থাকে। কানের শেষপ্রান্তে ছিদ্র করা স্থানে ব্যবহূত এক প্রকার কানের অলঙ্কারই বালি। এর আকৃতি সাধারণ আংটির মতো হয়ে থাকে।
কানের দুল উপমহাদেশের সর্বত্র ব্যবহূত সাধারণ কানের অলঙ্কারের মতো জনপ্রিয়। এটি ছিদ্র করা অংশে বা হুক দিয়ে কানে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
হাজা ফুল  ফুলের পাপড়ি সদৃশ কানের দুল। এটি একটি স্ক্রু বা পুশ দিয়ে কানে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
কান ফুল তারা আকৃতির এক ধরণের কানের অলঙ্কার। যা কানের ছিদ্র করা স্থানে পরিধান করে মেয়েরা।
ঝুংগা উপমহাদেশীয় ঝুমকা সদৃশ। ঝুমকার বা ঝুমকোর আকৃতি ঘন্টার মতো, তবে ঝুলন্ত ছোট ছোট বল থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে এর মধ্যে। এই অলঙ্কার কানে ঝুলিয়ে পড়তে বেশ পটু মেয়েরা।
আদিবাসীদের অলঙ্কার ঝুমালি  চেপ্টা ফুল আকৃতির সোনা বা রূপার কানের দুল। একটি ছোট হুক দিয়ে কানের ছিদ্র করা স্থানে পরিধান করতে হয়।
আজুলি, হনডুলি  চেপ্টা রূপার টুকরো দিয়ে তৈরি অর্ধচন্দ্রকার আকৃতি বিশিষ্ট কণ্ঠহার। এই অলঙ্কারকে বাড়িয়ে অর্ধ-বৃত্তাকারে গলার চারদিকে পরিধান করতে হয়।
টেংগা, কিংবা টাকা চারা রূপার মুদ্রা দিয়ে তৈরি এক ধরনের কণ্ঠহার। এই অলঙ্কার পাকানো কাপড়ের সুতা দিয়ে বুনন করা হয়। এই ধরণের অলঙ্কারকে 'আধূলি চারা ' এবং 'সিকি চারা' ও বলা হয়।
চিকচারা  সোনার বা রূপার তৈরি এক ধরণের গলবন্ধ জাতীয় গলার অলঙ্কার বিশেষ।
আলচারা এটি বিবাহ অনুষ্ঠানের একটি অলঙ্কার। ছোট ফুলদার আকৃতির রূপার টুকরো দিয়ে তিনটি লম্বা শিকল তৈরি করে রূপার ত্রিমুখী টুকরো দিয়ে এর মাথাগুলো আটকানো হয়।
চন্দ্রহার চন্দ্রহার দেখতে প্রাচীন বৈদিক-হিন্দুদের তৈরি করা গলার হারের মতো। বক্ষ সজ্জার জন্য রূপা বা সোনার লম্বা তারের টুকরো দিয়ে তৈরি এই অলঙ্কার বড় গোলাকার পদকের মতো। আর অর্ধবৃত্তাকারে গলা থেকে শিকলের সাহায্যে বক্ষে ঝুলে থাকে।
তাজজুর  বালা আকৃতির গোলাকার বাহু বন্ধনী। এর একটি অংশ চেপ্টা আর এর মধ্যে মূল্যবান পাথর খচিত থাকে।
তেলুলি চারা । এটি তাজজুরের সদৃশ্য। উপমহাদেশে এই অলঙ্কারকে বাজুবন্ধ বলে। পৃথক পৃথক রূপার টুকরো দিয়ে বাহুবন্ধ তৈরি করা হয়।  আর কাপড়ের সুতা দিয়ে শক্ত করে বাধা হয়।
বাংগুরি, বা বাংগুরি হচ্ছে মোটা রূপার বলয় বিশিষ্ট অলঙ্কার যা বালার মতো কব্জিতে পরতে হয়।
চুড়ি মাঝারি ধরণের পুরু বিশিষ্ট নকশা খচিত স্বর্ণের তৈরি অলঙ্কার।
আংটি আঙুলে পরার জন্য পাথরখচিত বা সাধারণ গোলাকার অলঙ্কার বিশেষ। নারী পুরুষ সকলেই পরেন এই অলঙ্কার। 
থেংগাককারু, পেয়ার কারু  নূপুর বা মল জাতীয় পায়ের অলঙ্কার বিশেষ। এই অলঙ্কার রূপা দিয়ে তৈরি আর একজোড়া হয়। এর ওজন প্রায় ৪০ তোলা পর্যন্ত হয়। বৃত্তাকার অংশটি পায়ের আঙ্গুল থেকে গোড়ালি পর্যন্ত সহজেই পরা যায়।
জলতরঙ্গ একটি থেংগাককারু অলঙ্কারের সদৃশ্য, কিন্তু ওজনে হালকা। এটি পাইপের মতো ভেতরে ফাঁপা। অলঙ্কারের উপরিভাগ কারুকার্য খচিত হয়।
ঝুনঝুনি, রূপার বলয় আকৃতির। বাঁকানো শিকলের সঙ্গে রূপার ছোট গোলাকার বলসংযুক্ত থাকে, যা শিশুরা কোমরে পরে।
গুণগুরু  শিশুদের পায়ের নূপুর বা মলের মতো অলঙ্কার বিশেষ। এই অলঙ্কারের রূপার বলয়ের সঙ্গে ছোট ছোট বল বা ঘন্টা যুক্ত থাকে। শিশু হাঁটার সময় বা হামাগুড়ি দিয়ে চলার সময় ঘন্টাগুলো শব্দ করে বেজে ওঠে।
চাকমা তাঁত চাকমাদের গৃহকার্যাদির মধ্যে নন্দনতাত্ত্বিক দিক থেকে সবচেয়ে পরিচিত, গুরুত্বপূর্ণ বস্ত। বেন (baen) বা তাঁত বেশ জনপ্রিয়। এই তাঁতের প্রধান ১২টি অংশ রয়েছে। আর প্রায় সবগুলো অংশই বাঁশ এবং সুপারি গাছের ছাও থেকে তৈরি। প্রত্যেক চাকমা মেয়েকে তার মা, জ্যেষ্ঠ আত্মীয়স্বজন তাঁতবুনন শিক্ষা দেয় এবং পরিবারের মধ্যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই দক্ষতা উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত হয়। বেন দক্ষতাকে একজন ভাল স্ত্রী এবং মায়ের গুণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বুনন শিল্পকলাকে এক ধরনের আধ্যাত্মিক মূল্যও দেওয়া হয়। আদিবাসী সমাজে প্রায় আট বছর বয়সের বালিকাকে বিভিন্ন প্রকার নকশা শিক্ষালাভের জন্য উৎসাহিত করা হয় এখনও। পুরুষরাও পরম্পরাক্রমে প্রাপ্ত পারিবারিক তাঁত বুনন তালিকা থেকে তার মা এই নকশাগুলো তাকে দেখায়। এই ব্যবস্থাকে আলুম বলে আদিবাসীদের সমাজে।
সাঁওতাল কারুশিল্প প্রাকৃতিক গাছ, আঁশ, পাতা, গাছের কান্ড, বাকল ইত্যাদি হচ্ছে আদিবাসীদের হাতে তৈরি শিল্পসামগ্রীর উপকরণের অংশ বিশেষ। এই শিল্পসামগ্রী গৃহের বিভিন্ন কাজে এবং উৎসব অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়।

লক্ষ্মীবাটিঃ

লক্ষ্মীবাটি টুকরি কড়ির বর্ম দিয়ে আবৃত আর লাল সালুর কাপড় দিয়ে জড়ানো বেতের ঝুড়ি। প্রতীকী এই বাটি কৃষি, সম্পদ আর সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মীর নামে উৎসর্গ করা হয়। প্রাচীনকালে ব্যবসা-বাণিজ্যে টাকার বিনিময় হিসেবে ব্যবহার করা হতো একে। লক্ষ্মীবাটিতে পদ্মফুলের আকারে কড়ি গেঁথে দেওয়া হয় যা দেবী লক্ষ্মীর প্রতীক। বাংলার আদিবাসীরা ছাড়াও কৃষক সমাজের মহিলা মহলে এর চল রয়েছে।


হাঁড়ের তৈরি শৌখিন দ্রব্যসামগ্রীঃ

গরু, মোষের ছাড়াও হরিণের শিং এর ব্যবহার হয়ে আসছে এ বাংলায়। শিং আর হাড়ের শিল্প শুধু পশ্চিম বাংলায় নয়, বাংলাদেশের ঢাকাতেও জনপ্রিয়। ঢাকার বাই-লেনগুলো হচ্ছে মহিষের শিং কেটে, খোদাই করে বিভিন্ন আকৃতি প্রদানের জন্য অন্যতম ঐতিহ্যবাহী একটি জনপ্রিয় স্থান। ১৮ শতকে মুসলিম কারিগর সম্প্রদায়ের মধ্যে এই দক্ষতার বিকাশ ঘটে ছিল। তারা আবিষ্কার করেন যে, মজবুত চিরুণি, বোতাম, চুলের ক্লিপ, কলমদানী আর অলঙ্করণের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরির জন্য শিং কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। হাঁটার সময় ব্যবহৃত লাঠি বা ছড়ি এবং প্রদীপ-দন্ড ধনী, ভদ্র পরিশীলিত শ্রেণি কিনে থাকেন গোটা দামে। প্লাস্টিক সামগ্রীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও এই কারুশিল্প বাড়ি, অফিস আদালতে সুন্দর বার্ণিশ করা স্থানে শোভা পায় এখনও জনপ্রিয়তার সঙ্গে।
মসলিন, জামদানি  বাংলার মূল্যবান তাঁতের বয়নশিল্প সূক্ষ্ম সুতো দিয়ে তৈরি সূক্ষ্মতম পণ্যসামগ্রী। যা 'মসলিন' নামে জনপ্রিয় ও পরিচিত। এসব সুন্দর স্বচ্ছ, নির্মল মাকড়সার জালের মতো বস্ত্রসামগ্রী প্রায় ২৫০০ বছর পূর্বে শীতলক্ষ্মা নদীর তীরবর্তী এলাকায় তৈরি হত। এসব এলাকার আর্দ্র আবহাওয়া সূক্ষ্ম সুতোকে নষ্ট হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতো। ধর্মীয় অনুষ্ঠান দিয়ে বুনন কাজ শুরু হতো এবং বিভিন্ন প্রকার বার্ষিক রীতিনীতিও অনুসরণ করা হতো। সূর্যের তাপ অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ার পূর্বেই তাঁতিরা খুব ভোরে বুনন কাজ শুরু করতো এই এলাকায়। পরে মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকার বিখ্যাত মসলিন কাপড়ে বিভিন্ন প্রকার নকশা সংযোজিত হয়েছে। এর নামকরণ করা হয় জামদানি (মদ বহনকারী পাত্র)। জামদানি হচ্ছে স্বচ্ছতা আর মনোমুগ্ধতার রূপক, নাম যার সঙ্গে দীপ্তিমান বা আলো ঝলমলে মদের তুলনা করা হয়। তাঁতের প্রাচীন চারু কারুশিল্পের উত্তরাধিকারী হিসেবে জামদানির মর্যাদা চিরায়ত এবং ঐতিহ্যবাহী বয়ন শিল্পের বর্ষপঞ্জিতে স্থানলাভ করেছে। বর্তমানেও এই শিল্প জীবন্ত চারু, কারুশিল্প হিসেবে বিবেচিত হয়। এবাংলার অজয়, দামোদর এবং ভাগীরথীর তীরে এই শিল্পের জনপ্রিয়তা ছিল মধ্যযুগে।